ঢাকা: ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে। আট বছর পেরিয়ে গেলেও একজন রোহিঙ্গাও নিজভূমে ফিরতে পারেনি। এর মধ্যে রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় রোহিঙ্গাদের ফেরার পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ হয় আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা এবং নতুন জন্মহারের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ।প্রত্যাবাসন চুক্তি সই হলেও এর বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি। রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের পথকে আরও কঠিন করে তুলেছে। কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, আরাকান আর্মির অত্যাচারে তারা নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। আরাকান আর্মি তাদের কিশোর-কিশোরী সন্তানদের নিজেদের বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করছে এবং পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে। এর ফলে নিজ দেশে ফেরার কোনো পরিবেশ নেই বলে তারা মনে করেন। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, “দিন দিন প্রত্যাবাসন জটিল হচ্ছে। তবে সবকিছুর পরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”একদিকে প্রত্যাবাসনের পথ অন্ধকার, অন্যদিকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তাও কমছে। ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ৯৩ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলারের তহবিল চাওয়া হলেও ১১ আগস্ট পর্যন্ত মিলেছে মাত্র ৩৩ কোটি ২ লাখ ডলার, যা চাহিদার মাত্র ৩৫ শতাংশ।বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা-ইসরায়েল সংঘাত এবং আফ্রিকার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দাতা দেশগুলোর মনোযোগ ও তহবিল অন্য দিকে সরে গেছে। এর ফলে কমে যাওয়া সহায়তার সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধার ওপর। তহবিল কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের জীবনমান আরও খারাপ হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে মাদক চোরাচালান ও মানবপাচারের মতো অপরাধ বাড়ছে।রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ইতিহাস অনেক পুরনো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)-এ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় কঙ্গো, বেলজিয়ামসহ আরও কয়েকটি দেশ যোগ দিয়েছে। এছাড়া, মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইংসহ বেশ কয়েকজন জেনারেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও সমতার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বারবার বলছে, এই সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন।
Discussion about this post