আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়া থেকে তেল কেনার ‘অপরাধে’ ভারতের থেকে রফতানি করা পণ্যের উপরে অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়েছে আমেরিকা। কিন্তু এ ভাবে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র ছিন্ন করা কি সহজ হবে? না কি তা আদৌ সম্ভব?রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া বহু দিনের। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনও দিনই বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি। রাশিয়া থেকে তেল, অস্ত্র কেনার জন্য ভারতকে একহাত নিয়েছেন। এ বার অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। এর ফলে ভারত থেকে আমেরিকায় রফতানি করা পণ্যের উপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়েছে। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই পদক্ষেপ হল ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক’। তাদের তরফে এ-ও জানানো হয়েছে যে, দেশবাসীর স্বার্থ সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ করবে তারা। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকোভও ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জানিয়েছেন, সার্বভৌম দেশের নিজের বাণিজ্যিক সহযোগী খুঁজে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাজমাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে বলেও জানান। এই আবহে ভারত সফরে আসছেন পুতিন।‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই ‘বন্ধুত্ব’ দীর্ঘ দিনের। ১৯৬০-এর দশকে চিনের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার পরে দিল্লির সঙ্গে মস্কোর ঘনিষ্ঠতা আরও প্রগাঢ় হয়। সে সময় ভারতকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছাড়ে তেল বিক্রি করত রাশিয়া। বাকি দেশগুলিকে যে দামে তেল দিত, তার থেকে কম দামে তেল বিক্রি করত ভারতকে। গত কয়েক দশক ধরে রুশ অস্ত্র কিনতে ভারতের জন্য কোটি কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থাও করেছে মস্কো। এমনকি, ভারতে তেল খুঁজতে ভূবিজ্ঞানীদের দল পাঠিয়েছিল রাশিয়া। ভারত যাতে সাইবেরিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনতে পারে, সেই অনুমোদনও দিয়েছিল মস্কো। এর ফলে ভারতের অর্থ বেঁচেছিল।১৯৭৪ সালে প্রথম বার পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার পরে ভারতের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল আমেরিকা। পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেছিল। সে সময় আরও কাছাকাছি আসে ভারত এবং রাশিয়া। দিল্লির গবেষণাকারী সংস্থা ‘অবজ়ারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ়ের প্রধান হর্ষ বি পন্থ বলেন, ‘‘এখনও বহু ভারতীয় রাশিয়াকে ভরসাযোগ্য সহযোগী মনে করেন। অনেকেই মনে করেন, আমেরিকা পাকিস্তানের প্রতি একটু বেশি সদয়।’’ভারতও বিভিন্ন সময়ে রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ থেকেছে ভারত। রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার এই পদক্ষেপকে ধিক্কার জানিয়ে যে ভোট হয়েছিল, তাতে বিরত ছিল দিল্লি। পাশাপাশি, রাশিয়া থেকে ক্রমেই অপরিশোধিত তেল ক্রয় বৃদ্ধি করেছে। গত বছর রাশিয়া যত তেল রফতানি করেছে, তার তিন ভাগের এক ভাগই কিনেছে ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধের পরে রাশিয়ার উপরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি। সে সময়ে কম দামে রাশিয়া থেকে তেল কিনেছে ভারত। ভারতের পাশাপাশি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাশিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে তেল কিনেছে চিনও।ভারত রাশিয়া থেকে কম দামে অপরিশোধিত তেল কিনে পেট্রোলজাত পণ্য তৈরি করেছে। তার পরে তা বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে মুনাফা লাভ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, গত তিন বছরে দুই দেশের মধ্যে ৬৯০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা। রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের স্থায়ী সদস্য সৈয়দ আকবরউদ্দিন সংবাদমাধ্যম ‘ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল’-কে জানিয়েছেন, নিকট ভবিষ্যতে এই তেল কেনা বন্ধ করছে না ভারত। কারণ, তা করলে ভারতের বাজেটে তার প্রভাব পড়ে যাবে। ডেটা এবং অ্যানালিটিক সংস্থা কেপিলারের প্রধান গবেষক সুমিত রিতোলিয়া জানিয়েছেন, রাশিয়া থেকে তেল কেনা এখন ভারতের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তার প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনীতিতে।শুধু তেল নয়, রাশিয়ার থেকে অস্ত্রও কেনে ভারত। ভারতের অস্ত্রভান্ডারে যত অস্ত্র রয়েছে, তার অর্ধেক রাশিয়ায় তৈরি। এমনকি, ভারত যাতে নিজের দেশে অস্ত্র তৈরি করতে পারে, সে জন্য প্রযুক্তিগত সাহায্যও করতে চেয়েছিল রাশিয়া। গত মাসে ভারতীয় নৌবাহিনী রাশিয়া থেকে কেনা রণতরী নিয়োগ করেছে। রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে আরও দু’টি রণতরী ভারত দেশেই তৈরি করছে। গবেষক সংস্থা কার্নেজি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের গবেষক অ্যাশলে জে টেলিস বলেন, ‘‘অস্ত্রভআন্ডারে রুশ অস্ত্রের বিকল্প পেতে এখনও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে ভারতকে।’’
Discussion about this post