স্পোর্টস রিপোর্ট: আগে তর্ক হতো, পেলে না ম্যারাডোনা সেরা? পরে তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পেলে-ম্যারাডোনা-মেসির মধ্যে কে সেরা? আরও পরে তর্কের নতুন বিষয়বস্ত হয়ে ওঠে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর মধ্যে কে সেরা? এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, মেসি নামটা প্রায় বারবারই এসেছে। পেলে-ম্যারাডোনার চেয়ে অনেক বিষয়েই এগিয়ে মেসি। পেলে কখনো ইউরোপের লিগে খেলেননি, কোপা আমেরিকা জেতেননি, অধিনায়কত্বের মতো গুরুদায়িত্ব সামলাননি, কখনো কোন দুর্বল বা আন্ডারডগ দলের হয়ে খেলেননি। ম্যারাডোনা ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলেছেন বার্সেলোনা, নাপোলি এবং সেভিয়ার হয়ে। দুর্বল নাপোলির হয়ে দু’টি লিগ এবং একটি ইউরোপা লিগ জিতলেও কখনো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জেতেননি তিনি। বেশিরভাগ পশ্চিমা ম্যাগাজিন ও ওয়েবসাইটের জরিপে মেসিকেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে বেছে নিয়েছে। একইভাবে বেশিরভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও বেশিরভাগ সাবেক ফুটবলারই তাকে সর্বকালের সেরা বলে মেনে নিয়েছেন। সর্বশেষ এমনটা মেনে নিয়েছে বিশ্বখ্যাত স্প্যানিশ ন্যাশনাল ডেইলি স্পোর্টস ট্যাবলয়েড “মার্কা”। তারা বৃহস্পতিবার মায়ামিতে মেসিকে ডেকে তার হাতে তুলে দিয়েছে “মার্কা আমেরিকা এ্যাওয়ার্ড”, যা কিনা, মেসিকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ। মেসিই একমাত্র ফুটবলার, যিনি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ‘লরিয়াস এ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন দু’বার, দক্ষিণ আমেরিকা ফুটবল সংস্থা (কনমেবল) তাকে ‘বিশ্ব ফুটবলের শাসক’-এর মর্যাদা দিয়েছে। ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে বেশি গিনেজ রেকর্ড মেসির। আরও আছে—সবচেয়ে বেশি দলীয় ট্রফি, ব্যালন ডি’অর ও ইউরোপিয় গোল্ডেন বুট জেতা, একমাত্র ফুটবলার হিসেবে দু’বার বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জেতা, দুর্বল ও অখ্যাত ক্লাবকে (ইন্টার মায়ামি) একক প্রচেষ্টায় শিরোপা জেতানো, ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি এ্যাসিস্ট, ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোলে অবদান রাখা, সবচেয়ে বেশি প্লেমেকার পুরস্কারপ্রাপ্তি, সবচেয়ে বেশি ফাইনালে গোল, ১ বছরে ও ১ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল, পেনাল্টি ছাড়া সবচেয়ে বেশি গোল, পেনাল্টি ছাড়া সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিক, জাতীয় দলের হয়ে প্রতিটি লেভেলেই শিরোপা জেতা … কত অর্জন আছে মেসির। শুধু তাই নয়। ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল, বেস্ট ক্রিয়েটর্স, বেস্ট ড্রিবলার, বেস্ট এ্যাসিস্টার্স ও বেস্ট ফ্রি কিক টেকার্স … প্রতিটি ক্যাটাগরিতেই টপ থ্রিতে থাকা একমাত্র ফুটবলারও মেসি। তিন দশকের মধ্যে প্রতি দশকেই কমপক্ষে ১০০+ গোল করা ফুটবলারদের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও আছে তার নাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার—একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার না হয়েও এবং একজন প্লেমেকার হয়েও মেসির গোলসংখ্যা বিস্ময়কর! তাছাড়া ফিফা বিশ্বকাপের ব্যক্তিগত সব রেকর্ডের বেশিরভাগই মেসি নিজের করে নিয়েছেন। ইউরোপিয়ান লিগে সবচেয়ে বেশি গোল ও ইউরোপের টপ ফাইভ লিগে সবচেয়ে বেশি গোলও তার। অভিষেকের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় একই ছন্দে খেলে যাওয়া বিরল ফুটবলার মেসি। খোদ ফিফাই বলেছে মেসিই সর্বকালের সেরা। কাতার বিশ্বকাপ শেষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে, তা নিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো ও লিওনেল মেসির মধ্যে যখন বিতর্ক তুঙ্গে ছিল, তখন এ প্রসঙ্গে ফিফা তাদের পক্ষ থেকে একটি টুইট করে জানায়, সেরা ফুটবলারের বিতর্ক শেষ। টুইটের নিচে তাদের পক্ষ থেকে মেসির ছবি পোস্ট করা হয়।অনলাইন ফিল্ম স্ট্রিমিং পরিষেবা আরেকটি অলিখিত রেকর্ড আছে মেসির। সম্ভবত তিনিই এই ধরণীর প্রথম এবং একমাত্র ফুটবলার, যাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যম যেসব নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই ভুল বা মিথ্যে প্রমাণ করেছেন মেসি। সেগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। * ভবিষ্যদ্বাণী-১ : ২০১৫ সালে কিংবদন্তী স্কটিশ কোচ স্যার এ্যালেক্স ফার্গুসন মন্তব্য করেছিলেন, ‘মেসি বার্সেলোনা ছাড়া অন্য কোন ক্লাবের হয়ে কিছু জিততে পারবে না।’ মিথ্যে প্রমাণ : বার্সা ছেড়ে মেসি ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে ৩টি এবং মার্কিন ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে (বিশ্বের ৮৭৫ নম্বর র্যাংকধারী ক্লাব, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ফুটবল ক্লাবগুলোর একদম তলানিতে) এখন পর্যন্ত ২টি শিরোপা জিতেছেন। * ভবিষ্যদ্বাণী-২ : ফ্রান্সের সাবেক কিংবদন্তী ফুটবলার মিশেল প্লাতিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘জাভি এবং ইনিয়েস্তা ছাড়া মেসি ঠিকমতো খেলতে পারবে না এবং কখনও সফল হবে না।’ মিথ্যে প্রমাণ : ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ মৌসুমের পরিসংখ্যান : জাভি-ইনিয়েস্তার সঙ্গে ১৫৩ ম্যাচ খেলে ১৫৯ গোল, ৬২ এ্যাসিস্ট; ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ মৌসুমে শুধু ইনিয়েস্তাকে নিয়ে ১৫৫ ম্যাচ খেলে ১৪০ গোল, ৬৪ এ্যাসিস্ট এবং ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ মৌসুমে জাভি-ইনিয়েস্তাকে ছাড়া ১৪১ ম্যাচ খেলে ১২০ গোল ও ৬৩ এ্যাসিস্ট করেছিলেন মেসি। এ পরিসংখ্যানে এটা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে জাভি-ইনিয়েস্তাকে ছাড়া খেলেও মেসির জাদুকরি পারফর্মেন্সে মোটেও ভাটা পড়েনি। * ভবিষ্যদ্বাণী-৩ : ‘মেসি হচ্ছে এক ক্লাবের (বার্সেলোনা) প্লেয়ার (বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম)। মিথ্যে প্রমাণ : স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা ছেড়ে মেসি এখন পর্যন্ত আরও দুটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। এবং ক্যারিয়ারে যতগুলো ক্লাব-ট্রফি জিতেছেন (৪০টি), সেগুলোর ৫টিই জিতেছেন বার্সার ছাড়ার পর। কাজেই মেসি বার্সা বাদে অন্য কোন ক্লাবে সফল হবেন না, এই ধারণাও ভুল প্রমাণ করেছেন এলএম টেন। * ভবিষ্যদ্বাণী-৪ : ‘বার্সার হয়ে মেসি প্রচুর ট্রফি জিতেছে, কারণ ওই দলে মেসির সঙ্গে জাভি-ইনিয়স্তা ছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে তারা না থাকায় মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জিততে পারেনি। আগামীতেও পারবে না’ (বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম)। মিথ্যে প্রমাণ : তিনটি কোপা ও একটি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও হেরেছিলেন মেসি। অন্যদিকে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ এবং উয়েফা নেশন্স লিগ জিতে সেরা ফুটবলারের লড়াইয়ে এগিয়ে যান অনেকটাই। কিন্তু ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা ও ২০২২ সালে ফিনালিসিমা জিতে মেসি এই অপবাদ গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হন। এরপর ২০২৪ সালে জেতেন আরেকটি কোপার শিরোপা। * ভবিষ্যদ্বাণী-৫ : ‘জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি (কোপা আমেরিকা) জিতলেও এটা ইউরোর চেয়ে অনেক কম মর্যাদাপূর্ণ এবং কম পরিশ্রমেই এটা লাভ করা যায়। তাছাড়া সবচেয়ে বড় মর্যাদাপূর্ণ ট্রফি হচ্ছে বিশ্বকাপ, যা মেসি কখনই জিততে পারবেন না। সেই সামর্থ্য তার নেই’ (বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম)। মিথ্যে প্রমাণ : ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ জিতে এই ভবিষ্যদ্বাণীকেও মিথ্যে প্রমাণ করেন মেসি। ৭ ম্যাচে ৭ গোল, ৩ এসিস্ট, টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার, ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিটি রাউন্ডেই গোল করাসহ একাধিক বিশ্বরেকর্ড করেন। মেসির একসময়ের বার্সার স্প্যানিশ সতীর্থ সেস ফ্যাব্রেগাস বলেছেন, ‘মেসিকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যেসব নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সেগুলো সবই ভুল প্রমাণ করেছে লিও। কাজেই তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলতে গেলে সবাইকে দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।’
Discussion about this post