স্টাফ রিপোর্টার(চট্টগ্রাম): নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এদেশে কোন নির্বাচন হবে না। এই দাবি আদায়ে লড়াই সংগ্রাম ও আন্দোলন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এই সরকার বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করেছে। বীর চট্টলা থেকে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বুধবার (১২ অক্টোবর) বিকালে চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ডে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির প্রথম বিভাগীয় মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সমাবেশে বিএনপির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতি, জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে বিএনপির যে পাঁচ নেতা প্রাণ হারিয়েছেন তার দায় সরকারের। এসব ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নয় তো তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরে যেতে বাধ্য করা হবে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন দলের শীর্ষ কমিটির নেতা ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আমান উল্ল্যাহ আমান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, গোলাম আকবর খন্দকার, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, রুমিন ফারহানা, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, লুৎফুর রহমান কাজল, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান শামীম, হারুনুর রশীদ এবং বিভাগীয় ও জেলা নেতারা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে নির্বাচিত সরকার নেই। শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার বাংলাদেশকে শ্মশান করে দিয়েছে। ভয়াবহ দানব এই সরকারকে পদত্যাগ করাতে হবে। লড়াই সংগ্রাম ও আন্দোলন ছাড়া তাই কোন সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম থেকেই শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। যা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকে আপনারা মেয়র নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার তাকে মেয়র ঘোষণা করতে দেয়নি। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এই চট্টগ্রাম থেকে সরকার পতনের দ্বিতীয় ধাপের আন্দোলনের সূচনা শুরু হল। জনগনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। গণতন্ত্র ফিরে পেতে চায় বাংলাদেশ। লড়াই করতে হবে। এই লড়াইয়ে জিততে হবে। আমরা যদি আন্দোলন করতে না পারি এদেশের মানুষ পরাধীন থাকবে। এটি বেঁচে থাকার লড়াই। দেশে নির্বাচিত সরকার নেই উল্লেখ করে উপস্থিত বিএনপি নেতাকর্মীদের মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ শ্মশান করে দিয়েছে ভয়াবহ দানব শেখ হাসিনার সরকার। তারা বিদেশে এদেশের অর্থ পাচার করে আমাদের জনগনকে গরীব করে দিয়েছে। ১০ টাকায় চাল দিবে বলে ক্ষমতায় এসে জনগণকে এখন ৭০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে হচ্ছে। সবকিছুরই দাম বাড়তি। তেল গ্যাস পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে ঘোষণা দিয়েছে। এসব মূলত লুটপাটের জন্য। তারা এদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় বেগমপাড়ায় বাড়ি করেছে, লন্ডনে সেকেন্ড হোম করেছে। টানেল হচ্ছে চট্টগ্রামে ভাল কথা। কিন্তু দারিদ্রসীমার নিচে দেশের ৪২ শতাংশ মানুষ। নিরাপত্তা নেই, ডাকাতি হয়, সম্ভ্রমহানি হচ্ছে- মা-বোনদের। এমন অবস্থা এসেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের র্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে আমরা বলতে চাই নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে শেখ হাসিনার সরকারকে। বিচার বিভাগ স্বাধীন নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক সাজা দেয়া হয়েছে। তারেক রহমানকে মামলা দিয়েছে। মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন এই জনসভায় আসার সময় পথে পথে বাধা দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ। কিন্তু জনগনের উত্তাল তরঙ্গ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এগিয়ে চলাকে দমিয়ে রাখা যাবে না। চট্টগ্রামে আন্দোলন থেকে স্ফুলিঙ্গ সারাদেশ জেগে উঠবে। স্বৈরাচার দানবীয় সরকারকে নামাতে হবে। এই সরকারের নির্বাচন কমিশনারকে কেউ মানে না। ডিসি এসপিরা মানে না। এটা কোন কমিশন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশে নির্বাচন হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোন নির্বাচন হবে না। চট্টগ্রামের বিএনপির নেতা আসলাম চৌধুরীকে দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা হয়েছে। এভাবে সারাদেশের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মামলা দিয়েছে। মিডিয়ার মালিকদের দলীয়করণ করা হয়েছে। ছাত্রলীগের কোন্দলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ জনগণের পকেট কেটে অর্থ পাচার করছে। ফখরুল সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। আমাদের দাবি শেখ হাসিনাকে পতন করতে হবে, পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, বিএনপির ৩৭ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। তারপরও বিএনপিকে নিঃশেষ করতে পারেনি, পারবেও না। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। শেখ হাসিনার ইচ্ছাতন্ত্র চলতে দেয়া হবে না। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই সমাবেশ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। পালানোর পথ খুঁজে পাবে না আওয়ামী লীগের নেতারা। আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সারাদেশে আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। রুমিন ফারহানা বলেন, মাফিয়া সরকার শেখ হাসিনাকে বলতে চাই, দেখুন চট্টগ্রামের ধানের শীষের জোয়ার। ১১ জেলা থেকে জমায়েত: পলোগ্রাউন্ডের মহাসমাবেশ বিকেলে হলেও সকাল থেকেই নেতাকর্মী ও সমর্থকরা চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে। চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে শত শত বাসযোগে তারা চট্টগ্রামে আসেন। এতে শহরের তিন প্রবেশ মুখ সিটি গেট থেকে একে খান, বহদ্দারহাট ও নতুন ব্রিজ এলাকায় তীব্র যান ও জনজটের সৃষ্টি হয়। খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে তারা পলোগ্রাউন্ডের সমাবেশে যোগ দেন। শহরের বাইরে থেকে হঠাৎ এত মানুষের চাপ আসায় স্থবির হয়ে পড়ে নগরীর একাংশ। বিশেষ করে টাইগার পাস, দেওয়ানহাট, কদমতলী, জিইসি এবং পলোগ্রাউন্ডের আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয় মিছিলে মিছিলে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ও বিভাগ পর্যায়ের নেতারা বেলা ২টার পর মঞ্চে উঠেন। শুরুতে জেলা ও বিভাগীয় নেতারা বক্তব্য দেন। বেলা ৩টার মধ্যে সমাবেশের মাঠ প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নেতাদের বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান। তারা দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। নেতারা কোন কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। তবে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আগামী দিনের কঠোর আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেন। ১০ বছর পর মহাসমাবেশ: প্রায় সাড়ে দশ বছর পর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হল বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশ। ২০১২ সালের ৯ মে এ পলোগ্রাউন্ডেই হয়েছিল সর্বশেষ মহাসমাবেশ। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। একই মাঠে এবারের সমাবেশ দলের নেত্রীর মুক্তির দাবিতে। সমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল বিএনপির। দু’সপ্তাহ আগে থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড পর্যায়ে মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। মহানগরীর নুর আহমদ সড়কস্থ দলীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে প্রায় প্রতিদিনই ছিল কোন না কোন কর্মসূচি। শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি: চট্টগ্রামে বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশ কোন ধরনের গোলযোগ ছাড়া সম্পন্ন হবে কিনা এ নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, শাসক দল সমাবেশে নানাভাবে বাধা প্রদানের ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেই নির্দেশনা রয়েছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সমাবেশ অনুষ্ঠানের পরিবেশ বজায় রাখতে। এদিন বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচুর সংখ্যক সদস্য মোতায়েন ছিল সমাবেশস্থল এবং কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। চট্টগ্রামে আসা মিছিলগুলোতে কোথাও কোন ধরনের বাধা প্রদান করা হয়েছে, এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিএনপির পক্ষ থেকেও তেমন অভিযোগ আসেনি। সন্ধ্যার আগে সমাবেশ শেষ হয়। এরপর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মিছিল সহকারে সমাবেশস্থল ত্যাগ করেন।
Discussion about this post