বিনোদন প্রতিবেদকঃ এক সময়ের সাবলম্বী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন এখন রুগ্নদশায় খুঁড়িয়ে চলছে। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা এতোটাই নাজুক যে কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দিতে হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চেয়েচিন্তে। অথচ প্রযোজকদের কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাওয়া পড়ে আছে। বকেয়া আদায়ে কেবল আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অপরদিকে বকেয়া দিতে না পারলেও নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেনাদাররা। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত স্বয়ং পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমনের বিপরীতে এফডিসি পাওনা ৩০ লাখ টাকার ওপর। এ নিয়ে ফুঁসছেন প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে থাকা কর্মচারীরা।
জানা গেছে, অর্থ না থাকায় গত ঈদের আগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিলো। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফান্ড আসার পরে বেতন বোনাস হয়েছে। গেল কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি এভাবে অর্থ ধার করে চলতে হচ্ছে। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেও একই অবস্থা বিরাজ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে সরেজমিনে যাওয়ার পর মিলল ভিন্ন চিত্র। প্রতিষ্ঠানটিতে নানা কায়দায় জমিয়ে বসেছে ছয়টি সমিতি। যার মধ্যে প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক সংস্থা, সিডাব রয়েছে। এদের কাছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি বিলই বকেয়া প্রায় কোটি টাকা!
অনুসন্ধানে এমন রিপোর্ট যখন হাতে ঠিক তখনই খোঁজ মেলে বিভিন্ন প্রযোজকদের কাছে এফডিসি আরো ২১ কোটি ৩৯ লাখ ৩২ হাজার ৩০৪ টাকা পাওনা। আর বকেয়া পাওনা আদায়ে হার্ডলাইনের পরিবর্তে নোটিশ নোটিশ খেলাতেই সীমাবদ্ধ কর্তৃপক্ষ। কেন এমন এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি এফডিসি কর্তৃপক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি অধিকাংশ প্রযোজকদের ঠিকানা ভুল, ফলে নোটিশ দিয়েও বিফল হচ্ছেন তারা। ফলে বুক ফুলিয়ে ঋণগ্রহীতারা কেপিআইভূক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে ঘুরে বেড়ায়। কাজ না থাকলেও সকাল-সন্ধ্যায় এয়ারকন্ডিশনে আড্ডা মারতে দেখা যায় তাদের।
এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ডিজিটাল যুগে প্রবেশের আগে অধিকাংশ ছবির শুটিং হতো এখানে। শুধু শুটিং না, ছবি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত ফিল্মের নেগেটিভ, পজেটিভ সবই এখান থেকে নিতে হতো। নির্মাণ পরবর্তী সকল সুযোগ সুবিধাও এখানে পাওয়া যেত। ফলে এফডিসির আয়ের কোনো কমতি ছিল না। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা প্রযোজকদের তিন পদ্ধতিতে শুটিং সুবিধা দিতেন। এগুলো হচ্ছে পি-ফিল্ম, সেমি পি-ফিল্ম ও জেনারেল।
পি-ফিল্ম পদ্ধতিতে একজন প্রযোজককে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এফডিসির তালিকাভুক্ত হতে হতো। এতে করে তিনি ছবির নেগেটিভ থেকে শুরু করে অন্যান্য জিনিস ও সার্ভিস বাকিতে নিতে পারতেন প্রযোজক। যা কিনা ছবি মুক্তির আগে পরিশোধ করে দিতে হত। দু-একটা ব্যতিক্রম ব্যতীত সকল ছবির ফাইনাল প্রিন্ট হত এফডিসির ল্যাবে। ফলে বকেয়া পরিশোধ না করে প্রযোজক কোনো প্রিন্ট নিতে পারতেন না।
সেমি পি-ফিল্ম পদ্ধতিতে প্রযোজক ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এফডিসির তালিকাভুক্ত হতেন। তিনি শুটিং ফিল্মের নেগেটিভ বা পজেটিভ কোনটাই পেতেন না। তবে বাকিতে ফ্লোর ভাড়া পেতেন। অন্যদিকে জেনারেল ক্যাটাগরিতে একজন প্রযোজক সমস্ত কাজই নগদ অর্থে করতেন।
প্রতিষ্ঠানটির অর্থ বিভাগ জানাচ্ছে, ডিজিটাল হওয়ার পর থেকে প্রযোজকদের এফডিসিকে ওই অর্থে কোনো বাকি দিতে হয়নি। যার কারণে টুকটাক কোন পাওনা থাকলেও তা ওইভাবে আলাদা করে ফাইল করা হয়নি। যে ২১ কোটির অধিক অর্থ পাওনার কথা বলা হচ্ছে তা মূলত ৩৫ মি.মি. ফিল্মের যুগের প্রযোজকদের কাছে পাওনা।
বকেয়া পরিশোধ না করতে পারলে তো ছবির প্রিন্ট পাওয়ার কথা না। তাহলে ৯৮টি ছবি মুক্তি এবং ৪০টি ছবি সেন্সরে জমা পড়লো কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এফডিসির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. হেমায়েত হোসেন বলেন, দেখা যেত একই প্রযোজকের একাধিক ছবি তখন আমাদের এখানে কাজ হতো। তখন তিনি তার বাকি ছবিগুলো জামানত রেখে একটি ছবির মুক্তির জন্য প্রিন্ট নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে ওই ছবিগুলো হয়তো মুক্তি পায়নি কিংবা সেন্সরে আটকে গেছে। তখন প্রযোজকরা আর ওই বকেয়া পরিশোধ করেননি।
আপনারা কি তাদের নোটিশ দেননি? মো. হেমায়েত হোসেন জানান, তারা অসংখ্যবার আইনি নোটিশ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা জানান, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশ সমিতির কাছে এ ব্যাপারে সহায়তা চেয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছে এফডিসি। কিন্তু তারা এর কোনো উত্তর দেননি। তিনি জানান, অধিকাংশ প্রযোজক যে ঠিকানা কাগজপত্রে দিয়েছেন সেখানে তাদেরকে পাওয়া যায় না।
তবে এ অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন প্রযোজক নেতারা। সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম খসরু ও সামসুল আলম দুজনেই গণমাধ্যমকে জানালেন তারা চিঠির জবাব দিয়েছেন।
খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘এফডিসি পর্ষদের মিটিংয়ে কয়েক বছরে আগে আমরা বলেছিলাম, যে ছবিগুলো বকেয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই আটকে গেছে ৩৫ মি.মি. থেকে ডিজিটালে হুট করে রূপান্তরের কারণে। ছবিগুলো শেষ করতে না পারায় মুক্তি দেওয়া যায় নি। আবার তখন মুক্তি দিতে পারলে প্রযোজকরা ভালো টাকা পেতেন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। তাই আমাদের প্রস্তাব ছিলো এফডিসি তাদের কাছে সার্ভিস চার্জ বাবদ যে টাকা পায়, তা মওকুফ করে দিয়ে শুধু র মেটারিয়ালের বিলটা নেওয়ার। তখন সেটি ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে পাশ করে আমাদেরকে জানানোর কথা ছিল।
সামসুল আলম বলেন, ‘এফডিসি যদি আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী পাওনা টাকার একটা অংশ মওকুফ করে দিত তাহলে প্রযোজকরা টাকা ফেরত দিতে পারতো। কারণ তারাও তো ক্ষতিগ্রস্থ। আবার অনেক প্রযোজক মারাও গেছেন। জীবিত প্রযোজকদের অধিকাংশই চান টাকাটা ফেরত দিতে। কিন্তু তার আগে তো একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
খালি চিঠি ও মামলার হুমকি দিয়ে এ টাকা আদায় হবে না বলে দাবি করেন খোরশেদ আলম খসরু। তিনি বলেন, টাকা আদায়ে কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে এফডিসিরই। আমরা শুধু সহায়তা করতে পারবো।
সরেজমিনে গিয়ে নথিপথ থেকে দেখা গেছে, সর্বমোট ৩১৯টি ছবির প্রযোজকের কাছে এফডিসির এ পাওনা। এ ছবিগুলোর মধ্যে ৯৮টি ছবি মুক্তি পেয়ে গেছে। যাদের কাছে পাওনা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৭ টাকা। সেন্সর হয়ে গেছে বা জমা পড়েছে কিন্তু মুক্তি পায়নি এমন ছবির সংখ্যা ৪০টি। যাদের কাছে পাওনা ৫ কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার ১৬৬ টাকা। পি-ফিল্ম ক্যাটাগরির ৪০টি ছবির কাছে পাওনা ৪ কোটি ৯৪ লাখ ১ হাজার ৮৭৮ টাকা। সেমি পি-ফিল্ম ক্যাটাগরির ৩৯টি ছবির মধ্যে ৩৬টি ছবির কাছে পাওনা ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৭ হাজার ২৮৪ টাকা। বাকি টাকা জেনারেল ক্যাটাগরির ১০২টি ছবির কাছে পাওনা।
সর্বোচ্চ পাওনা পি-ক্যাটাগরিতে অপূর্ব কথাচিত্রের ‘ভয়ংকর ডেঙ্গু’ ছবির প্রযোজকের কাছে ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৩ টাকা। সর্বনিম্ন পাওনা ২৫ আগস্ট ১৯৮৭ সালে মুক্তি প্রাপ্ত রবিন ফিল্মসের ‘অসহায়’ ছবির প্রযোজক এম এ মান্নানের কাছের ১১ হাজার ৯৫২টাকা। এছাড়া এ তালিকায় প্রখ্যাত সাংবাদিক, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক আহমেদ জামান চৌধুরীরও নাম রয়েছে। তার প্রযোজিত ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘যাদুর বাঁশী’ ছবির কাছে পাওনা ৫৬ হাজার ১১৫ টাকা। গড়ে প্রতি প্রযোজকের কাছে এফডিসির পাওনা সাড়ে ৬ লাখ টাকার অধিক।
এদিকে দেবী, প্রমোশন ও গুলি সিনেমার বিপরীতে পরিচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহীন সুমনের কাছে এফডিসি ৩০ লাখের বেশি পাওনা রয়েছে বলে হিসাব কর্মকর্তা হেমায়েত নিশ্চিত করেছেন। বলেন- কয়েক দফা নোটিশ দেওয়া হয়েছে কাজ হয়নি।
অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলেন- সমিতিগুলোর কোনো কাজ নেই অথচ তারা দিব্যি এখানে এসে এয়ারকান্ডিশন চালিয়ে গা জুড়াচ্ছে। অথচ তাদের কাছেই বকেয়া রয়েছে এক কোটি টাকা! এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালকই তৎপর নন বিধায় টাকা আদায় হচ্ছে না।
চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন, যেহেতু এফডিসিতে খুব একটা কাজ নেই, তাই সমিতিগুলো ভেতরে থাকারও সুযোগ নেই। এখানে বসার সুযোগে তারা নানা রকম ফিল্মি পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে নেতিবাচক সংবাদে সয়লাব হচ্ছে, ফলে চলচ্চিত্র দর্শক হারাচ্ছে, দ্রুতই এ অবস্থার উত্তরণ প্রয়োজন।
Discussion about this post