স্টাফ রিপোর্টার: ভূমির মালিকানায় নারীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ে নারীর সংখ্যাই অধিক। ভূমির মালিকানায় নারীরা সবসময় বৈষম্যের স্বীকার। গ্রামীণ নারীরা কৃষিতে সরাসরি যুক্ত কিন্তু ভূমি মালিকানায় তাদের নেই কোন অংশ। একইভাবে আদিবাসী নারীরাও তাদের ভূমি মালিকানায় পিছিয়ে। বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক ও ধর্মীয় আইন, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধান, যেমন: অর্পিত সম্পত্তি আইন, পরিবারিক উত্তরাধিকার আইন, আদিবাসীদের প্রথাগত সম্পত্তির স্বীকৃতি না থাকায় তা ভূমি দখলকারীদের অনুকূলে চলে যাচ্ছে। ভূমির মালিকানা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয় বরং সামাজিক মূলধন হিসেবে কাজ করে। প্রান্তিক, দরিদ্র, ভূমিহীন নারীদের ভূমিতে প্রবেশাধিকারের একমাত্র উপায় খাসজমি। এখানেও নারীরা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) ইনসিডিন বাংলাদেশ এবং সাউথ এশিয়া অ্যালায়েন্স ফর পোভার্টি ইর্যাডিকেশন (SAAPE) এর যৌথ উদ্যোগে এই মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সভায় মূল ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ইনসিডিন বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী। তিনি বলেন, SAAPE (সেইপ) যে বিশ্বাসকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে তা হলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঐক্যের প্রয়োজন। এই ঐক্যের মঞ্চ হিসেবে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং জাতিগতভাবে সামাজিক যে ফোরাম রয়েছে তা আমাদের দেশেও বিদ্যমান। যেখানে বিশ্বায়নকে মানবিকায়ন করার ভাবনা রয়েছে। প্রান্তিক নারী শব্দটি দুর্বলতাকে নয় বরং বৈষম্যকে প্রতিফলিত করে। সমাজে যে নারীর অবস্থান শক্তিশালী, প্রান্তিক নারীর সাথে তার স্ববিরোধী অবস্থান রয়েছে। একদিকে আমরা ভাবছি প্রান্তিক নারীর অধিকার নিয়ে অপরদিকে তাদের দিয়েই আমাদের নারীমুক্তি ও সমাজ বদলের আশা। সভায় বক্তারা আরো বলেন, খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্টন নীতিমালা যেখানে প্রান্তিক নারীদের কোন প্রবেশাধিকার নেই। বৈষম্যের পরিবর্তন করে নারী বিশেষত প্রান্তিক নারীদের ভূমি মালিকানায় ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজ সময়ের দাবি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইনসিডিন বাংলাদেশ এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার অ্যাডভোকেট রফিকুল আলম, অপারেশন চিফ মো. মুশফিকুর রহমান, সিএসপি ফোকাল পারশন শেখ জেসমিন নাহার, ফিল্ড অফিসার নীতু ক্লাহ্রি, ওয়ার্কিং উইমেনস ফোরোমের সভাপতি, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সহ সভাপতি আনজুমান আরা শিল্পী, বিশিষ্ট সাংবাদিক সাজেদুর রহমান সহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা। গত দুই মাসব্যাপী ২৪টি সংগঠন, সরকারী প্রতিনিধিসহ নাগরিক ও সরকারী পর্যায়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। প্রান্তিক, দরিদ্র, ভ‚মিহীন নারীদের ভ‚মিতে প্রবেশাধিকারের সংগঠনের ভূমিকা ও কার্যাবলী বিশ্লেষণ, ভ‚মিতে নারীর পূর্ণ অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে প্রচলিত নীতি কাঠামোর প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় এবং জাতীয় পর্যায়ে সরকারী, বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের উপায় নির্ধারণ। মতবিনিময় সভা থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়: ১. ভ‚মি মালিকানার ক্ষেত্রে আইনের পরিমার্জন ও তার সার্বজনীন প্রয়োগ দরকার। ২. ‘প্রান্তিক নারী’ এই শব্দের ব্যবহার নারীর অবস্থান দুর্বল করে। তাই শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। ৩. শিক্ষাক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। ৪. আদিবাসীদের স্বার্থ সুরক্ষায় রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশাপাশি সমাজের সকলের সহাবস্থান কামনা। ৫. নারীর ভ‚মি উত্তরাধিকার নিশ্চিতে একটি চলমান ফোরাম গঠন যা একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। ৬. নারী অধিকার ও ভ‚মি অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্তিক পরিবর্তন জরুরী। নারী যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্য না দাঁড়াবে পরিবর্তন আসবে না। ৭. খাস জমি নারীর নামে প্রত্যয়ন নারীর অভিগম্যতা বৃদ্ধি করে। ৮. ‘স্বামী পরিত্যক্তা’ ভাতা শব্দটি নারীকে আরও অপাংত্তেয় করে। শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। ৯. নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ১০. আইন ও ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রচার দৃঢ় করতে হবে। ১১. যোগযোগের ভাষা করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিকবর্গকে সম্পৃক্ত করা যাবে না। ১২. আমাদের আলোচনাকে সংবিধান ও আইন প্রণয়ণ প্রক্রিয়ায় তুলে ধরতে হবে। ১৩. নারী কৃষকের ভ‚মিহীনতা বিবেচনায় এনে কৃষি ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা। ১৪. নারী কৃষকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং বাজার ব্যবস্থায় নারী অভিগম্যতা নিশ্চিত করা। ১৫. কৃষি, বন, পাহাড় রক্ষা এবং ভ‚মিতে আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার স্বীকৃতি প্রদান করা। ১৬. সমতলের আদিবাসীদের ভ‚মি অধিকার রক্ষায় আদিবাসী ভ‚মি কমিশন গঠন। উপস্থিত বক্তারা তাদের বক্তব্যে আরো বলেন, বিশ^ব্যাপী ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ করতে গেলে নারীদের ভ‚মি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান আইনে যদি কাঠামোগত কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তবে তাও করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভ‚মি মালিকানা প্রাপ্তি নারীদের জন্য কোন সুযোগ বা দয়ার বিষয় নয় বরং এটি তাদের মৌলিক মানবাধিকার। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে প্রান্তিক নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর এর শুরু করতে হবে ভ‚মি মালিকানা প্রাপ্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে যা আমাদের মানবিক সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
Discussion about this post