ঢাকা: আগামী ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে চীন সফরে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পে অর্থয়ন করছে চীন। বড় প্রকল্পগুলোর অগ্রগায়নে চীনের অর্থায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর চীনের ঋণছাড়াও নতুন বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়নে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংকট কাটাতে বড় ধরনের বাজেট সহায়তাও আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে মেট্রো রেল এমআরটি লাইন-২ ও ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা চার লেন প্রকল্পে সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। এ ছাড়া চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সাত বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা ও রিজার্ভ সহায়তা আসতে পারে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার বিষয় চূড়ান্ত হতে পারে। ইআরডি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন শীর্ষক একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছিল। সেখানে ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস রয়েছে। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯টি প্রকল্পের জন্য ৮.০৭৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলো দ্রুত সই করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরে আলোচনা হতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফর উপলক্ষে অর্থসংক্রান্ত বড় ধরনের সহায়তা আশা করছে বাংলাদেশ। তিন ধরনের সহযোগিতা নিয়ে যোগাযোগ চলছে—বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সরাসরি অর্থ সহায়তা, বাজেট সহায়তা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ সহায়তা। ইআরডি সূত্র বলছে, তিন ধরনের সহায়তার বিষয়ে চীনা পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়। সফরে শীর্ষ বৈঠকের আগে কোনো কিছুই আসলে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ইআরডির সংশ্লিষ্ট এশিয়া উইংয়ের প্রধান মিরানা মাহরুখ গণমাধ্যমকে বলেন, বাজেট সহায়তা ও রিজার্ভ সহায়তা চাওয়ার তথ্য সঠিক নয়। প্রকল্প সহায়তা নিয়েই এখন পর্যন্ত কথা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কী পরিমাণ ঋণ সহায়তা চাওয়া হবে, তা-ও এখনো নির্ধারিত হয়নি। কত প্রকল্পকে চীনা ঋণের আওতায় আনা হবে, সেটা নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা। সুতরাং প্রকল্প সংখ্যা নির্ধারিত হওয়ার আগে ঋণের পরিমাণও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। ইআরডি সূত্র আরও জানায়, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, এমআরটি লাইন-২ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৪৫ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ থেকে নেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। অবশিষ্ট তহবিল সরকার সরবরাহ করবে। বর্তমান বিনিময় হার প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসাবে এই অঙ্ক প্রায় ৫.২ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। অর্থাৎ প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন ডলার এই প্রকল্পে ঋণ চাওয়া হবে। সফরে এমআরটি লাইন-২ ছাড়াও ফরিদপুর-বরিশাল ও বরিশাল-কুয়াকাটা চার লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য চীনা অর্থায়ন চাওয়া হতে পারে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩.৩৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বৈদেশিক ঋণ থেকে ২.৫৭৯ বিলিয়ন ডলার জোগানের প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সফরে চীন দেশে ৩০-৩৫টি ছোট আকারের সেতু ও দুর্যোগকালীন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অর্থায়নের ঘোষণা দিতে পারে। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়েও একটি চুক্তি সই হতে পারে। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়াসংক্রান্ত বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে একটি সমঝোতাও সই হওয়ার কথা রয়েছে। ইআরডির তথ্য মতে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতিতে চীনের অবস্থান চতুর্থ। পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫.৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট ঋণের ৮.৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট ঋণ স্থিতি ৬২.৩১ বিলিয়ন ডলার। চীন সরকার সাধারণত দুই ধরনের ঋণ দিয়ে থাকে। মার্কিন ডলারে প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) ও চীনের নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল) বা সরকারিভাবে দেওয়া রেয়াতি ঋণ। ইআরডির তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ঋণ ও অনুদান মিলে মোট এক হাজার ২৯ কোটি ১৯ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এ সময় অর্থছাড়ের পরিমাণ ৬৫৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত ১২ বছরে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এ ছাড়া ১০.২৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি। দেশটি পদ্মা রেল সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় বড় প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে। গত তিন বছরে দ্বিগুণ হয়েছে চীনের ঋণছাড়ের পরিমাণ। রিজার্ভ ঘাটতিতে সহায়তার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশ রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় সহযোগিতা চেয়ে চীনকে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এ নিয়ে নতুন ঘোষণা আসবে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরে দুই দেশের কৌশলগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করেছি, যার বিস্তারিত যথাসময়ে ঘোষণা করা হবে। ’ চীনের বড় ঋণ নিয়ে সরকার ফাঁদে পড়বে কি না জানতে চাইলে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোন দেশ ঋণ দিচ্ছে, সেটা বিষয় নয়। প্রয়োজনীয় প্রকল্পে ঋণ নিলে কোনো দেশের ঋণই সমস্যা নয়। ঋণের প্রয়োজনে প্রকল্প নিলে হবে না, প্রকল্পের প্রয়োজনে ঋণ নিতে হবে। সবার আগে প্রকল্পের প্রয়োজন দেখতে হবে। এরপর সেই প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভজনক, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। ’
Discussion about this post