মোস্তাফিজুর রহমান সুজন: ৮ থেকে ৯ জন শিশু শিক্ষার্থীর হাতে একটি করে পাতিলে নিয়ে ওদের গন্তব্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু সবার হাতেই একটি করে পাতিল। সেই পাতিলের মধ্যে রয়েছে বই-খাতা-কলম আর স্কুলড্রেস। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পাতিলবহণের কারণ জানতে ওদের সঙ্গে হেঁটে যাওয়া। কিছুদূর যেতেই একটি খাল চোখে পড়লো। সেই খালে একেক করে পাতিল নিয়ে নেমে পড়ে শিক্ষার্থীরা। শীতের এই সময়েও শীতল পানিতে সাঁতার কাটতে থাকে ওরা সবাই। মাঝখালে গিয়ে দুই-একজন ক্লান্তও হচ্ছিল। নিচ্ছিল দম। একপর্যায় চোখের আন্দাজে প্রায় ২৫০ ফুট চওড়া খালটি সাঁতরে পার হয় সবাই। তীরে উঠেই রোদে দেয় ভেজা জামা-কাপড়। গায়ে পড়ে স্কুলড্রেস। অবশেষে বই-খাতা নিয়ে ছোঁটে স্কুলে। স্থানীয়রা বলছেন, তাদের কাছে এই দৃশ্য নতুন কিছু নয়- প্রায় ২৫০ ফুট চওড়া এ খাল পাড় হতে কোন সেতু নেই। নৌকা পারাপারেও নেই কোন স্থায়ী ব্যবস্থা। বাধ্য হয়ে খাল সাঁতরে স্কুলে যায় ওরা। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চললেও খালে সেতু নির্মাণের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। তবুও জীবন বাজি রেখে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ গ্রাম নামক দুইটি চর থেকে এভাবে খাল সাঁতরে স্কুলে আসা-যাওয়া করে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা। ওদের মধ্যেরই একজন কেয়ামনি (৯)। চতুর্থ শ্রেণী পড়ুয়া এ শিক্ষার্থীর বাড়ি দিয়ারচর গ্রামে। পড়ালেখা করে মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এর মাঝখানে বয়ে যাওয়া বাইলাবুনিয়া নামক একটি খাল সাঁতরে ওর যেতে হয় স্কুলে। কেয়ামনি নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার আমাদের আসতে অনেক ভয় হয়। দুই-এক সময় হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা (ছুটে) যায়। আমরা অনেক কষ্ট করি স্যার। শিশু শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত অনেক কষ্ট করছি। এখনও এক বছর কষ্ট করা লাগবে। দুই তিনদিন আগে হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা গেছে। আমরা অনেক কান্না করছি। কেউ ছিল না। পরে আমরাই আস্তে আস্তে কিনারে আসছি। বই খাতা ভিজে গেছে। এখনও শুকায়নি।’ কেয়ামনির মত ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণী পড়া জান্নাতুল, নাসরিন, চতুর্থ শ্রেণীর নাজমুলও বলে, ‘খাল সাঁতরে স্কুলে যেতে ভয় করে ওদের। কষ্ট হয় এই শীতে খাল পার হতেও।’ তাই শিশু শিক্ষার্থীদের দাবি খালটিতে একটি সেতু নির্মাণের। এদিকে, খাল সাঁতরে স্কুলে যাওয়ার কথা শুনে স্থায়ী সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত ওই খালে নৌকা দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করবে চরমোন্তাজ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একে সামসুদ্দিন আবু মিয়া। স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ গ্রামে কোন স্কুল নেই। তাই পার্শ্ববর্তী মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে ওই দুই চরের শিশুরা। কিন্তু স্কুল এবং দুই চরের মাঝখানে বাইলাবুনিয়া খাল। এ খাল পেড়িয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের। কেউ খাল সাতরে পার হয়। কেউ আবার পার হয় নৌকায়। কোমল হাতে নিজেই নৌকার বৈঠা বেয়ে খাল পার হওয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইউসূফ বলে, ‘যহন নৌকা পাই, তহন স্কুলে আই। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নোনা জলে সাঁকো বেশিদিন টিকে না। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে সাঁকো থাকাকালীন ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিল। এরমধ্যে দুই শ’ এর মতো শিক্ষার্থী ছিল ওই দুই চরের। সাঁকো না থাকায় এখন শিক্ষার্থী কমে গেছে। এখন দুই চর থেকে ৫০ জনের মত শিক্ষার্থী আসে। এদের কেউ কেউ নিয়মিত আসেও না। শিক্ষার্থী অভিভাবক দিয়ারচর গ্রামের জাকির হাওলাদার বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এই স্কুলে পড়ে। সপ্তাহখানেক আগে আমার এক ছেলে খাল পার হতে গিয়ে ডুবে যাওয়া ধরছে। আমি এসে উডাউয়া (উঠিয়ে) স্কুলে দিয়ে গেছি। আমার অনেক কষ্টে এই দুই ছেলে এখন স্কুলে আনা-নেওয়া করতে হয়। এর চেয়ে এখানে একটি স্কুল হলে ভাল হয়। আর তানাহলে এই খালে একটি ব্রিজ হলেও ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়তে দেওয়া যায়।’ মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজের শিক্ষার্থীরা পাতিল নিয়ে খাল সাতরে এই বিদ্যালয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসে। অনেক অভিভাবকই এই ঝুঁকি নিয়ে ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে আসতে দেয় না। যদি স্কুলের পূর্ব পাশের এই খালে একটি ব্রিজ হতো, তাহলে শিশু শিক্ষার্থীরা এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পেত।এই শীতের সময়ে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট হয়। অনেকেই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে আসে। অনেকে নিয়মিত স্কুলেও আসতে পারে না।’ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গম এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা একটি খাল পেড়িয়ে আমাদের স্কুলে আসতে হয়। সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য বেশকিছুদিন আগে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প কি করা যায় এজন্য আমরা উর্ধ্বতণ কর্তৃপক্ষ, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আছে তাদের সাথে আলাপ করে অতিদ্রুত বিষয়টি সমাধাণের চেষ্টা করবো।’ এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মিজানুল কবির বলেন, ‘শিশু শিক্ষার্থী এবং জনস্বার্থে ওই খালের ওপর ব্রিজ (সেতু) নির্মাণ জরুরি। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে প্রস্তাবনা পাঠাব।’ এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ বলেন, ‘এলজিইডি সরেজমিনে খাল পরিদর্শন করবে এবং ব্রিজের প্রস্তাব দেবে। আপাতত শিশুদের পারাপারের জন্য নৌকা দেওয়া হবে।
Discussion about this post