ঢাকা: মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া আগামী বছরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বছরের শেষ সময়ে এসে মাধ্যমিক ও সমপর্যায়ের প্রায় ২১ কোটি বইয়ের পুনঃ দরপত্র হচ্ছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের পুনঃ দরপত্র আহবান করা হয়েছে। যেহেতু পাঠ্যবই ছাপার বিষয়টি এখনো দরপত্র পর্যায়ে রয়েছে, কাজেই ছাপার বিষয়টি আরো সময় নেবে।এতে আগামী বছর যথাসময়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার বিষয়টি সংশয়ের মধ্যে পড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক দরপত্রে যায়নি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এবার দেশীয় প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে বই ছাপার কাজ। বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই হাতে পাওয়া অনেকটা উৎসবে পরিণত হয়েছিল। চলতি বছর এতে ছেদ পড়ে।সূত্র জানায়, চলতি বছর পাঠ্যবই হাতে পেতে শিক্ষার্থীদের সময় লেগেছিল মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। তাই আগামী বছর যাতে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে একটি রোডম্যাপ অনুযায়ী আগেভাগে কাজ শুরু করে এনসিটিবি। সব দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ক্রয় কমিটিতেও পাঠিয়েছিল তারা।কিন্তু মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার অনুমোদন দেয়নি ক্রয় কমিটি। স্বাভাবিকভাবে নবম-দশম শ্রেণিরও অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে বছরের শেষ সময়ে এসে ২১ কোটি বইয়ের পুনঃ দরপত্রে যেতে হচ্ছে এনসিটিবিকে।শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৬ আগস্ট ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বই ছাপাতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮-এর বিধি ৮৩(১)(ক) কিছুটা সংশোধন আনা হয়। পিপিআরের ৮৩(১)(ক) অনুযায়ী. উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির ক্ষেত্রে দরপত্র প্রস্তুত ও দাখিলের জন্য বিজ্ঞাপনের তারিখ থেকে কমপক্ষে ৪২ দিন সময় দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।তবে জরুরি প্রয়োজন বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ সময়সীমা কমানোর সুযোগ রয়েছে। সেই বিধিতে সংশোধিত প্রস্তাব পাস করেছে ক্রয় কমিটি। এর মাধ্যমে দরপত্রে সময়সীমা ৪২ দিনের জায়গায় ১৫ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে।প্রেস মালিকরা বলছেন, দরপত্র উন্মুক্তের পরও বেশ কিছু প্রক্রিয়া থাকে। এনসিটিবি ফাইল প্রস্তুত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। মন্ত্রণালয় তা ক্রয় কমিটিতে উপস্থাপন করবে। সেখান থেকে অনুমোদনের পর প্রেস মালিকদের সঙ্গে এনসিটিবির চুক্তি করতে হবে। চুক্তির পর প্রথম পর্যায়ে বই ছাপতে ৭০ দিন সময় পাবেন প্রেস মালিকরা। যদিও এরপর নানা উপায়ে সেই সময় বাড়ানো যায়। ফলে সব প্রক্রিয়া শেষে মাধ্যমিকের কিছু বই ছাপার কাজ শুরু হতে পারে অক্টোবরের প্রথমার্ধে। আবার কিছু বই ছাপার কাজ শুরু করতে হবে অক্টোবরের শেষে। ফলে ছাপার জন্য ৭০ দিন সময় নির্ধারিত থাকলেও জানুয়ারির প্রথমার্ধ পর্যন্ত সুযোগ পাবেন প্রেস মালিকরা। এরপর নানা উপায়ে আরো পরে বই দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে জানুয়ারির শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘গত মঙ্গলবার আমরা ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের পুনঃ দরপত্র আহবান করেছি। বুধবার আহবান করেছি সপ্তম শ্রেণির। দরপত্রসহ অন্য সব প্রক্রিয়ার সময় কমানো হয়েছে। এ বছর বইয়ের সংখ্যা ১০ কোটি কম। প্রেসগুলোর ক্যাপাসিটির চেয়ে কম কাজ দেওয়া হচ্ছে। প্রেসের সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া এখন পুরোদমে প্রাথমিকের কাজ চলছে। সেগুলো আগেভাগেই শেষ হয়ে যাবে। এর পরও ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ তুলে আনতে আমাদের কষ্ট হবে। কিন্তু তার পরও কাজটা করা যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’ সূত্র জানায়, প্রাথমিকের ৯ কোটি বই ছাপার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ক্রয় কমিটি। গত ১৯ আগস্ট ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৮০২ কপি বই ছাপতে তিনটি প্রস্তাব ক্রয় কমিটিতে উত্থাপিত হয়, যার মোট ব্যয় ধরা হয় ৬০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। নানা অভিযোগ তুলে সেটি অনুমোদন দেয়নি কমিটি। অন্যদিকে মাদরাসা পর্যায়ের ইবতেদায়ি ও নবম-দশম শ্রেণির দরপত্র মূল্যায়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এনসিটিবি।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ঘিরে দরপত্রের শুরুতেই নানা বিতর্ক দেখা দেয়। চলতি বছর প্রেস মালিকরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা বা সিন্ডিকেট করে দরপত্রে অংশ নেন। এর মধ্যে অন্তত ৪০টি প্রেস ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে নিম্নমানের বই দিয়েছে। এমনকি মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেকশন এজেন্টদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের বইকে ভালোমানের বই বলে সত্যায়ন করে এজেন্সিগুলো। এ ছাড়া সরকারের ক্রয় কমিটির কাছে অভিযোগ ছিল, চলতি বছর ৩০ কোটির বেশি বইয়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে আওয়ামীপন্থী প্রেস মালিকদের কাছে।জানা যায়, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই রব্বানী জব্বারের মালিকানাধীন আনন্দ প্রিন্টার্স ও এপেক্স প্রিন্টার্স শুধু তিনটি শ্রেণির ৭২ লাখ বইয়ের কাজ পায়। সাবেক একজন মন্ত্রীর ভাই ও আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বর্তমান সময়ে কিভাবে এত কাজ পান—সেই প্রশ্ন তুলে বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে জানতে চান কমিটির অন্য সদস্যরা। এ ছাড়া ২২৭টি লটের বিপরীতে ৯টি প্যাকেজ করায় আপত্তি তোলে টেকনিক্যাল কমিটি। ফলে মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির বই ছাপার অনুমোদন দেয়নি ক্রয় কমিটি। এ ছাড়া নবম-দশম শ্রেণিরও প্রায় ৩০ লাখের বেশি বইয়ের কাজ পেয়েছেন রাব্বানী জব্বার। ফলে সেই দরপত্রেরও অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, মাধ্যমিকের আগের দরপত্র বাতিল হলেও পুনঃ দরপত্রেও রাব্বানী জব্বারসহ ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী প্রেস মালিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের কিছু কাজ পাওয়ার কথা। তবে যেসব প্রেস মালিকের সরাসরি আওয়ামী লীগের পদ-পদবি ছিল, তাঁরা যেন কাজ না পান, সে উপায় খোঁজা হচ্ছে। তাঁরা দরপত্রে অংশ নিলেও কোনো না কোনো উপায়ে তাঁদের কাজের বাইরে রাখা হবে।
Discussion about this post