ঢাকা:রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভোরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত সম্পদ হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে আর্তনাদ করছেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী।ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- বস্তির প্রবেশমুখে বৈদ্যুতিক পিলারে অবস্থিত ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের সূত্রপাত। মাঝেমধ্যেই এই ট্রান্সফারে বৈদ্যুতিক গোলযোগ হলেও এর সুষ্ঠু প্রতিকার মেলে না। এবারও এই ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়েই আগুন লাগে একটি ভাঙারি দোকানে। সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা বস্তিতে।দমকল বাহিনী বলছে- বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণেই ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যদিও এ ঘটনায় কেউ মারা যায়নি বা কেউ আহতও হয়নি। আগুনে বস্তিবাসীর শতাধিক ঘরসহ ৩০টির বেশি দোকানও পুড়ে গেছে।গতকাল বুধবার (১২ মার্চ) রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি ঘুরে ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা যায়। পুড়ে যাওয়া বস্তির বাসিন্দা নিলুফা বেগম বলেন, আমার পরিবারে পাঁচজনের সদস্য কত কষ্ট করে জিনিসপত্র জোড়াইছি।তিনি বলেন, ফ্রিজ, র্যাক, দুটি ওয়ারড্রব, আলমারি সব পুড়ে শেষ; কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করি। আর আমার স্বামী রিকশা চালায়। ঘরে আমার বৃদ্ধা শাশুড়ি আছে। এখন কোথায় যাবো? আমাদের সব শেষ। শুধু পরনের কাপড়টা নিয়ে ঘর থেকে বের হেতে পেরেছি।গত ১৮ বছর ধরে সাততলা এই বস্তিতে বসবাস করছে সালমা বেগম (৪০)। আগুনে সব হারিয়ে অন্যদের মতো তিনিও পথে বসেছেন। তিনি বলেন, রাত ৩টা ১৫ মিনিটে যখন আগুন লাগছে, প্রথমে ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট হয়েছে। পরে সেই ট্রান্সফরমারের নিচে একটা ভাঙারির দোকান ছিল সেই দোকানে আগুন লেগেছে। তারপর পুরা বস্তিতে আগুন লেগে গেছে।’তার অভিযোগ, এই ট্রান্সফরমারে প্রায়ই আগুন লাগে। কিন্তু এটা ঠিক করে না।তিনি আরও বলেন, আমার এখানে ঘর ছিল। আমার ঘরের ওপরে আমাদেরই আরেকটা রুম করা ছিল। এই দুই ঘর মিলায়ে আমার ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আজ ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে কষ্ট করে যা যা করেছি, সব শেষ হয়ে গেছে চোখের সামনে। কিছুই করতে পারিনি। আমার স্বামী কাঠমিস্ত্রি। বড় মেয়ে ক্লাস নাইনে, মেজোটা ক্লাস ফোরে পড়ে। আর একটা মেয়ের বয়স ৩ বছর, অন্য মেয়েটার বয়স ১ বছর। তাদের নিয়ে আমরা এখন কোথায় যাবো?মাথার ওপর একটি বিছানার চাদর টাঙিয়ে পরিবার নিয়ে বসে ছিলেন বশির আহমেদ। তিনি বলেন, রাত ৪টার দিকে উঠে দেখি আগুন টিনের ওপর উঠে গেছে। তখন আমরা সবাই চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, এখানে ভাড়া থাকতাম। ঘরে টিভি, ফ্রিজ, খাট, আলমারি নগদ টাকা সব ছিল। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই নেই। এখন কোথায় থাকবো তারও ঠিক নেই। কোনও আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। তাছাড়া আর কী করার! নবম শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী প্রতিভা সরদার। সে বলে, বই খাতা কিচ্ছু নেই সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। কত টাকা দিয়ে বই কিনেছিলাম, সব শেষ। সরকার থেকেও কিছু বই দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার বই কিনবো কোথা থেকে, কীভাবে করবো পড়াশোনা?এ দিকে বিকালে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ওই বস্তিটিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের থেকে ত্রাণ নিয়ে আসতে দেখা গেছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবককে। পার্শ্ববর্তী এলাকার স্বেচ্ছাসেবক রাসেল বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে ত্রাণগুলো পাঠিয়েছে। আমরা রাস্তা থেকে এনে এখানে বিতরণ করছি। তাদের হিসাব অনুযায়ী- ওই বস্তিতে ৩০০ ঘর আর সেখানে ৩০০ পরিবার বসবাস করতো। তারা সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এর আগে বুধবার দিবাগত রাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের আপ্রাণ চেষ্টায় দেড় ঘণ্টা পর আগুন নেভানো সম্ভব হয়।উল্লেখ্য, এর আগেও একাধিকবার আগুন লেগেছিল এই সাততলা বস্তিতে।এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (ঢাকা) মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, বস্তির অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণেই ঘটে থাকে। এটাও আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ হলে প্রকৃত কারণ বলা যাবে। এছাড়া এখন নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিমাণ হিসাব করলে শতাধিক ঘর আগুনে পুড়েছে। তাদের একেকটি ঘরে ছোট ছোট আট থেকে ১০টি কক্ষ রয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্তের ঘরের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
Discussion about this post